সিরাজগঞ্জর তাড়াশে গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুতে ব্যস্ত
ঝন্টু, সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধিঃসিরাজগঞ্জর তাড়াশে গাছিরা খেজুর রস সংগ্রহের জন্য গাছ প্রস্তুতে ব্যস্ত। কারণ শীতের আগমনী বার্তা শুরু হয়েছে। দিনে খরতাপ আর রাতের শেষ ভাগে অনুভূত হচ্ছে শীত। আবার ভোরে কুয়াশা ও শিশির বিন্দু দেখা যাচ্ছে লতা-পাতা, ঘাস ও আমন ধানের ডগায়। আর এ থেকেই বুঝা যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদে শীতের আগমনী বার্তা। খেজুরের রস সংগ্রহ যেহেতু শীত কালেই করা হয়। তাই গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহের প্রস্তুতি স্বরুপ গাছের ডাল ও শাখা-প্রশাখা কেটে সাফ করছেন।
উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ও গাছিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করতে হলে প্রথমে খেজুর গাছের মাথা ভালো করে পরিষ্কার করে সাদা অংশ কেটে রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। পরবর্তীতে সাদা অংশ আবারও কেটে নলি লাগিয়ে তাতে ছোট-বড় বাসন বেঁধে রস সংগ্রহ করা হয়। এই রস কাচা খাওয়া যাবে আবার জ্বাল দিয়ে গুড়ও তৈরি করা যাবে। এরই ধারাবাহিকতায় জমির আইলে, রাস্তার পাশে ও পুকুর পাড়ের খেজুর গাছ গুলোর ডাল কেটে পরিষ্কার করছেন গাছিরা। সকল প্রক্রিয়া শেষে শুরু করবেন রস সংগ্রহ। খেজুর গাছ থেকে রস পাওয়ার এ প্রক্রিয়াকে আঞ্চলিকভাবে বলা হয় কাম দেওয়া।
তাড়াশ উপজেলা বারুহাস ইউনিয়নের রানীদিঘী গ্রামের গাছি ইয়াছিন রস সংগ্রেহের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলেন, সাধারনত কার্তিক মাসে রস সংগ্রহের জন্য গাছ গুলো প্রস্তুত করতে হয়। তবে শীতের আগমনের জন্য এবার একটু আগেই গাছ প্রস্তুত করছি। একটা গাছকে ডাল পালা কেটে প্রস্তুত করতে ১দিনের মতো সময় লাগে। রস সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয় এবং হাড়ির ধারন ক্ষমতা ৬ থেকে ১০ লিটারের মতো হয়। রস কে ভালো রাখার জন্য হাড়ির ভিতরে চুনের প্রলেপ দেয়া হয়। তবে যে গাছের কাচা রস খাওয়া হয় সে গাছের হাড়িতে কোন চুন দেয়া হয় না। তিনি আরও জানান, একটা গাছ থেকে ২ থেকে ৩ মাসের মতো রস পাওয়া যায়। গাছ ভেদে ১ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত রস পাওয়া যায়। গাছ থেকে রস সংগ্রহের একটা নিয়ম আছে তা হলো প্রথম ৩ দিন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে পরবর্তী ৩ দিন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যাবে না। একে আমরা বলি পালি দেয়া, আর এ নিয়মেই চলবে যতদিন পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হবে। বিকেল ৩ ঘটিকা থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে গাছে হাড়ি বাঁধি। পরদিন কুয়াশা ঘেরা ভোররাত অর্থাৎ ৫/৬ টা থেকেই শুরু হয় আমাদের রস সংগ্রহের কাজ। প্রথমে গাছ থেকে রস নামিয়ে নিচে রাখা বড় পাত্রে ঢেলে রাখি এভাবে সব গাছের রস নামানো শেষ হলে তা বাড়িতে নিয়ে আসি। এর পর শুরু হয় পরবর্তী ধাপের কাজ অর্থাৎ গুড় তৈরীর কাজ। প্রথমেই রস গুলোকে ছেকে বড় একটা খোলায় (পাত্রে) জাল করা জন্য ঢালা হয়। এরপর শুরু হয় জাল করা। আগুনের তাপে ধিরে ধিরে রস কমে যায় এবং লাল রং ধারন করতে থাকে। এ সময় এই লাল রস থেকে সুস্বাদু ঘ্রান বের হয় যা পাশে থাকা মানুষকে পাগল করে দেয়। তিনি আরও জানান, বয়স হয়েছে আগের মতো আর কাজ করতে পারিনা, যুবক বয়সে ১০০ থেকে ১২০টি পর্যন্ত গাছ লাগাতাম। বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০টি গাছের রস সংগ্রহ করর এবং তা থেকে দানা লালি গুড় বানাবো। এক কেজি গুড় বানাতে ১২ থেকে ১৫ কেজি রসের প্রয়োজন হয়। তাছাড়াও যেহেতু নিজের কোন গাছ নাই, তাই গাছের মালিককে প্রতি গাছে ২ থেকে ৩ কেজি গুড় দিতে হয়। যেহেতু ছোট বেলা থেকেই এই কাজের সাথে আছি তাই বাদও দিতে পারছি না। একদিকে বয়স বাড়ছে অন্যদিকে গাছের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমার পরবর্তী জেনারেশান রস সংগ্রহের জন্য প্রয়োজনীয় গাছ পাবে কিনা যতেষ্ঠ সন্দেহ আছে!
খেজুর রস সংগ্রহকারী গাছি মোতালেব, শরিফুল, আজমল ও জাহিদুল জানান, সাধারণত এখন বেশী গাছ পাওয়া যায় না। ২০ থেকে ৩০টি মতো গাছ থেকে রস সংগ্রহ করব। এর মধ্যে দুই এক জনের নিজের কিছু গাছ থাকলেও বাকি সবারই অন্যের গাছ ঠিকা নিয়ে রস সংগ্রহ করতে হয়। প্রতিটা গাছের জন্য গাছের মালিককে দিতে হবে ৭ কেজি লালি গুড় অথবা ১ হাজার টাকা করে। গাছ প্রস্তুত প্রায় শেষ এবার অপেক্ষা রস সংগ্রহের।
তাড়াশ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শর্মিষ্ঠা সেন গুপ্তা জানান, খেজুর গাছের জন্য বাড়তি কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না তাই, কৃষি বিভাগ কৃষকদের বাড়ির আশপাশ, জমির আইল, পুকুরপাড় এবং সড়কের ধারে খেজুর গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। পরিত্যক্ত জমিতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে খেজুর বাগান গড়ে তোলা হলে কৃষকেরা লাভবান হবেন।








